Valobashar Golpo শরতের মেঘ


ওপর দিকে মাথা তুলতেই তাকে দেখা গেলো। বারান্দার জাফরীকাটা রেলিং ধরে সে দাঁড়িয়ে আছে। গাঢ় হলুদ রঙের শাড়ি। চোখে মোহময়ী দৃষ্টি। দেখল তিনজনেই। অখিল, শুভময়, নন্দ। একবার, দুবার, তিনবার, বারবার দেখেও চোখ ফেরাতে পারছে না যেন।
অখিল মূখ দিয়ে অভ্যেস মতো একটা শুব্দ করল – কেখেছিস। কে বল্‌তো?
– নতূন আমদানি মনে হচ্ছে। পবন দাদুর কোনো আত্মীয় হবে।
নন্দ বললে – কী সেজেছে রে! একবার ডাকব না কি?
শুভময় আর সময় নষ্ট করল না। সত্যি সত্যিই ডাকার ভাঙ্গিতে ইশারা করল। এখান থেকে দুরত্ব মোটামুটি হাত পঞ্চাশেক । বুড়োশিবতলার এই খোলামেলা চত্বরটা যেনবা অখিল, শুভময়, নন্দদের খাস্তালুক। পাড়ার যাবতীয় বাসিন্দা এবং তাদের মোটামুটি আত্মীয়দের সাতকাহন এদের নখদর্পণে। আলোচনার বিষয়ও এসব নিয়েই কেন্দ্রীভূত সেই পাড়ায় নতুন এক ত্রুণীর আগমন স্বভাবতই মাথা ঘুরিয়ে দেয়। গরম গরম আলোচনায় মুখর। কিন্তু কেউই ভাবতে পারেনি যে এরকমটা ঘটে যাবে। শুভময়ের সামান্যতম ইশারায় মেয়েটা একেবারে ওদের সামনে এসে হাজির হলো। ঠান্ডা গলায় জিগ্যেস করল – আপ্নারা কি আমাকে ডাকছেন/
ওর যেন কথা হারিয়ে ফেলেছে। ভাবগতিক দেখে সে হেসে ফেলল – আরে, চুপ করে আছেন কেন? আমার মনে হলো যেন আমাকেই ডাকলেন। আমি পবনদাদুর বাড়িতে এসেছি। ওঁর ছেলে আমার বাবার বন্ধু। আমার নাম কল্পনা। কল্পনা রায়।
একসঙ্গে এতোগুলো কথা অনায়াসে বলে যাওয়ার পরে সে চুপ করল। তার স্বচ্ছন্দ ভাব্বভঙ্গি দেখে অখিল মুখ খুলল বসুন না, দাঁড়িয়ে রইলেন কেন? আমরাও এ পাড়াতেই থাকি। আমি অখিল, ও শুভময়, আর ও হচ্ছে নন্দ।
পরের দিন সকালে দেখা গেলো কল্পনা শুভময়ের সঙ্গে স্কুটারে চেপে ঘুরছে। শুভময়ের কাঁধটা শক্ত করে ধরে বললে-আপনি এতো জোরে গাড়ি চালান কেন?
– আপনার বুঝি ভয় করছে?
-মোটেইই না। বেশ ভালো লাগছে। কিন্তু, আজ আফিসে গেলেন না কেন?
-নাই বা গেলাম। ক্ষতি কী! চলুন, আপনাকে শহরের ওপাশটা দেখিয়ে আনি।
সেদিন বিকেলের পড়ন্ত বেলায় গঙ্গার জেটিতে অখিলের পাশে দাঁড়িয়ে কল্পনা বললে – আমি পূর্বদিকে মূখ করে দাঁড়াচ্ছি। আমাকে নিয়ে সূযার্ন্তের একটা ফটো তুলুন।
একটা নয়, বিভিন্ন ভঙ্গিতে অখিল তিনটে ফটো তুলল। তারপর বললে-বাড়ি ফেরার যখন তাড়া নেই তখন আসুন গঙ্গার পাড় ধরে খানিকটা হাঁটি।
অপরাহ্ণের এই পরিবেশটা বড় মনোরম। একটা কাশফুল টেনে নিয়ে কল্পনা বললে-আমি এখন কিছুদিন থাকব। আপ্নারা সত্যি বড় ভালো। একদিনের মধ্যেই সেটা বুঝে গেছি। আপনাদের কাউকে কোনোদিনই ভুলতে পারব না।
অখিল গম্ভীর গলায় বললে – শুভময় কিন্তু অনেক বাজে কথা বলে। ওর সব কথা আমরাই বিশ্বাস করি না।
-তাই নাকি? শব্দ করে হেসে উঠে কল্পনা, – কিন্তু ভালো স্কুটার চালায়। পেছনে চেপে থাকলেও এতটুকু ভয় করে না।
-স্কুটারটা ও নিজে কেনেনি। মামা দিয়েছে। ওর বাড়ির অবস্থা তেমন ভালো নয়।
পরেরদিন বিকেলে কল্পনাকে নন্দর সঙ্গে দেখা গেলো ময়দানে। দু’জনে পাশাপাশি বসে ফুচকা খাচ্ছে। নরম জমিতে আঙুল চালিয়ে ঘাস ছিঁড়তে ছিঁড়তে কল্পনা বললে – আমদের কলেজ খুলতে আর ষোলোদিন বাকি। কী করে যে আপনাদেরকে ছেড়ে থাকব। আপনাদের সঙ্গে মিশে ভীষন আনন্দ পেলাম।
নন্দ প্রসঙ্গ পাল্টাল – আপনি সিনেমা দেখতে ভালবাসেন?
– হ্যাঁ। অবশ্য বাংলা বই। আমি ম্যাগাজিন পড়তে ভালোবাসি।
ফুচকা খেতে ভালবাসি। কাশফুল পছন্দ করি। গঙ্গার ধারে আঁড়িয়ে সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখতে তো ভীষণ ভালো লাগে। কাল আপনার বন্ধু আমাকে সূর্যাস্ত দেখিয়েছে।
– কে, অখিল? নন্দ্র গলা একধাপ খাদে নামল – ও আবার একটু বেশি আবেগপ্রবণ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, অখিলের শরীরে অসুখ আছে। এই তো কিছুদিন আগেই টি. বি. হাসপাতাল থেকে ঘুরে এলো। রোগটা ছোঁয়াচে।
তার পরের দিন বিকেল হওয়ার আগেই বুড়োশিবতলার চত্বরে প্রথম হাজির হলো শুভময়। স্কুটারে বসেই বারকয়েক হর্ন বাজাল। একটু পরেই এলো নন্দ। পকেটে সিনেমার দু’খানা টিকিট। এবং প্রায় সঙ্গে সজেই এলো অখিল। সঙ্গে ছাতাও এনেছে। আকাশে মাঝে মাঝেই মেখ জমছে। শরতের মেঘ যখন-তখন ভিজিয়ে দেয়। কোনো ভরসা নেই।
নন্দ বললে – আমরা আজ সিনেমা যাবো। কল্পনা বাংলা বই দেখতে চেয়েছে।
শুভময় অবাক হলো – কিন্তু আমাদের তো আজ বেলুড়মঠ যাওয়ার কথা। ওখান থেকে দক্ষিণেশ্বর হয়ে ফিরব – এরকমই ঠিক আছে।
অখিল আশ্চর্য গলায় বললে – সে কী! কল্পনার তো আজ আমার সঙ্গে নৌকায় চাপার কথা। গঙ্গার বুকে ভাসতে ভাসতে ও গান গাইবে। কল্পনা রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখে।
ওরা তিনজনেই ঠায় অপেক্ষা করতে লাগল। ঘুরে – ফিরে বারবারই দৃষ্টি গিয়ে ধাক্কা মারে সেই জাফরী কাটা রেলিং – এ। ক্রমশ অধৈর্য হয়ে ওঠে।
একটু পরে সদর দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসে পবনদাদু। অখিল সাহস নিয়ে জিগ্যেস করে – দাদু, কল্পনা কী করছে?
-কল্পনা। সে আবার কে?
-কল্পনা। কল্পনা রায়। ওর বাবা তো আপনার ছেলের বন্ধু। আপনাদের বাড়িতে এসেছে।
-ও, তোমরা ছবির কথা বলছ। সে তো চলে গেছে।
-চলে গেছে! কখন? তিনজনেই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল।
-আজ সকালেই। ওর বাবা এসেছিল অন্য কাজে। বাবা চাইছিল ছবি এখানে কিছুদিন থাকুক। কিন্তু মেয়ে জেদ ধরে আজই চলে গেলো।
অখিল, শুভময়, নন্দ্রা বিস্ময়ে কথা হারিয়ে ফেলেছে
-ছবির সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, তাহলে তো ওর বিয়েতে নিশ্চয়ি তোমাদের নেমন্তন্ন হবে।
শুভময় অস্ফুটে বললে – ছবির বিয়ে কখন/ কোথায় হচ্ছে/
-সামনের মাসে। মেয়ে কলেজে ঢুকেই সবকিছু ঠিক করে ফেলেছে ওদের কলেজেরই প্রফেসার। অবশ্য বাড়ির কারুর অমত নেই।
পবনদাদু চলে যেতেই নন্দ পকেট থেকে টিকিট দু’খানা বের করে ছিঁ’ড়ে ফেলল, ধ্যুৎ! সবকিছুই মাটি হয়ে গেলো একেবারে।
অন্যরা চুপচাপ। দেখতে দেখতে বৃষ্টি নামল এক পশলা। মেঘটুকু সর যেতে যতক্ষণ। আকাশের দিকে তাকিয়ে শুভময় বললে- কেন জানিনা, আমাকে কাল কল্পনা হঠাৎ জিগ্যেস করে বলল, আপনি এতো বাজে কথা বলেন কেন? বেশি বাজে কথা বললে এক সময় নিজেকেই ছোটো হতে হয়।
কল্পনা হোক বা ছবি হোক মেয়েটা কিন্তু খারাপ নয়। অখীল ধীরে-সুস্থে বললে – আমাকেও বলছিল, আপনি সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিন। অতে আপনার শরীর খারাপ হবে। ….. ভাবছি এবার আসতে আসতে তা-ই করব।
নন্দ আর কোনো কথাই বলেনি সে চোখে-মুখে যেন এক্রাশ দুঃখ নিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। জায়গায় জায়গায় মেঘ জমাট বাঁধা। ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে, ফের বৃষ্টী নামবে।
শরতের মেঘের স্বভাব চরিত্রই এরকম। যেখানে দাঁড়ায় সেখানটাই ভিজিয়ে দিয়ে যায়।

Author:

Facebook Comment